দক্ষ জনসম্পদ হলো প্রতিষ্ঠানের প্রাণ, কিন্তু যেসব প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ প্রক্রিয়াটি স্বচ্ছ নয়, ভবিষ্যতে তার মূল্য দিতে গিয়ে ওই প্রতিষ্ঠান নজিরবিহীন দুর্গতির মুখোমুখি হয়। আর একপর্যায়ে দেউলিয়াত্বের মতো অসহায় দুরাবস্থাকে বরণ করতে হয়। কারণ, মেধাবী ও কর্মঠ শ্রমশক্তি নিয়োগদানে ব্যর্থতার দায়ভার নিয়োগ কমিটি কখনো এড়াতে পারে না। আর হাতের নাগালে তথা কোনো পরীক্ষা ব্যতিত চাকরি পাওয়ার ফলে নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মীবাহিনীর জবাবদিহিতার সৃষ্টি হয় না, তাই প্রতিষ্ঠানের নীতি-নৈতিকতাকে চরমভাবে অবহেলার পাশাপাশি নিজেদের স্বার্থ সিদ্ধিতেই ব্যস্ত থাকে। পক্ষান্তরে সঠিক পন্থায় নিয়োগ পরীক্ষার মাধ্যমে নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মীবাহিনী প্রতিষ্ঠানের আদর্শকে সমুন্নত রাখতে সর্বোচ্চ সচেষ্ট থাকেন। এতে প্রতিষ্ঠান তার অগ্রগতিতে কখনো থমকে যায় না। যথার্থ পদ্ধতিতে নিয়োগ পরীক্ষাসহ কর্মী নির্বাচন প্রতিষ্ঠানের দূরদর্শিতারই অন্যতম ধাপ হিসেবে বিবেচিত।
‘আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে, কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে।’ কবির এই আহ্বানের প্রতিধ্বনিতে গত ক’দিন ধরে আমার চারপাশটা বিদীর্ণ হয়ে আছে। চাকরির সুবাদে অনেক প্রতিষ্ঠানের সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যুক্ত থেকে খুব কাছ থেকে ‘নীতির কেবল আনুষ্ঠানিক প্রদর্শন’ দেখেছি আর বারবার উল্লেখিত অভিব্যক্তি আমায় উপহাস করেছে। সত্যিই তো, আজকাল কথা দিয়ে চিড়া ভিজে, কাজ হয়, পাশাপাশি পদন্নোতিসহ সুবিধাবাদী ‘সুশীল’ হওয়া যায়। কিন্তু সমাজের পরিবর্তনে, অধিকার ও অগ্রগতিতে সচেতনের ভূমিকাই সবচেয়ে বেশি, হোক সে সাধারণ কিংবা অসাধারণ ব্যক্তিত্ব। একজন সচেতন মানুষের সক্রিয়তায় চতুর্দিকের অপশক্তি সবসময় ভীত ও সতর্ক থাকে। সততা ও আপসহীন ব্যক্তির সঠিক মূল্যায়ন ছিল, আছে ও থাকবে। তবে ক্ষণিকের ¯্রােতে অনেক অশুভশক্তির প্রভাব মহাকালকে গ্রাস করে ফেলে। অস্বীকারের সংস্কৃতিতে সুন্দর ও সৃজনশীলতার অবমূল্যায়ন হলেও কালের ইতিহাসে কেবল সত্যের দাপটই স্থান পায়।
কোনো প্রতিষ্ঠানে কর্মকর্তা ও কর্মচারি নিয়োগের ক্ষেত্রে কিছু অফিসিয়াল নিয়ম-কানুনের আবশ্যকতা রয়েছে। আর ‘নিয়োগদান’ প্রক্রিয়াটি এসব নৈতিকতার অন্যতম ইস্যু হিসেবে বিবেচ্য। অথচ, পরিতাপের বিষয় হলো প্রাতিষ্ঠানিক নিয়োগ প্রক্রিয়ায় সংশ্লিষ্ট পরিচালনা পর্ষদ ও প্রভাবশালী মহলের অন্যায্য আবদার তথা অনুপ্রবেশ। বিশেষ করে স্বজনপ্রীতি ও ব্যক্তিস্বার্থ রক্ষার আড়ালে নিয়োগদান প্রক্রিয়ায় অসদুপায় অবলম্বন করা হয়। আর এই অকর্মের ফল দিতে হয় চরমভাবে। চারদিকের অনেক প্রতিষ্ঠানে খেয়াল করলে দেখা মিলবে এসব অনিয়মের। যেখানে কোনো ধরনের নিয়োগ পরীক্ষা ছাড়াই কর্মীদের নিয়োগদান করা হচ্ছে। ‘অমুক ভাই পাঠিয়েছে, তাকে বাদ দেয়া যাবে না’ বা, ‘অল্প পারিশ্রমিকে দিন-রাত খাটানো যাবে, নিয়ে ফেলেন’ কিংবা ‘আনুষ্ঠানিক নিয়োগদান প্রক্রিয়াটি অনেক ব্যয়বহুল ও সময়ের ব্যাপার, আমাদের মধ্য থেকেই প্রমোশন দিয়ে দেন বা অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে নিয়োগ প্রদান করা যেতে পারে’- এ ধরনের অনুরোধ বা আদেশবলে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ প্রক্রিয়া চরমভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে।
এমনও নজির আমাদের চারপাশের প্রতিষ্ঠানগুলোতে ঘটেছে, ক্ষমতার অপব্যবহারে কর্তাব্যক্তি তার পরিবারের সদস্য ও আত্মীয়স্বজনের অবাধ নিয়োগ দিয়ে শেষ পর্যন্ত অকর্মের ফলস্বরূপ নিজের চেয়ারটিই হারাতে বাধ্য হয়েছেন। আবার অনেক প্রতিষ্ঠানের অব্যবস্থাপনার সুযোগে বিপুল টাকা হাতিয়ে নিতে ক্ষমতাবলে ‘আপন লোক’কে ‘গোপন’ চুক্তিতে নিয়োগ দিয়ে সরিয়ে নিচ্ছেন বিশাল অঙ্কের টাকা। ‘অল ইন ওয়ান’ সুবিধাটি সুনিশ্চিত করতে সুকৌশলে বনে যাচ্ছে সুবক্তা, আর তোষামুদে স্বভাবের ‘জায়গা-মতো’ প্রয়োগে বাগিয়ে নিচ্ছেন পদোন্নতিসহ কর্তৃপক্ষের আস্তাভাজন ব্যক্তি’র জায়গাটি। কিন্তু এভাবে আর কতোদিন চলবে? সভ্যতার বিকাশে মনুষ্যত্বের কী কোনো ভূমিকা নেই? যদি মানবিক দিকটিই প্রশ্নবিদ্ধ হয়, তবে আমরা ‘সভ্য ও আধুনিক’ দাবি করাটা কতোটা যৌক্তিক?
‘আপন গা বাঁচিয়ে অধিকারের নাম বেচা’ টাইপের লোক সমাজে বাড়ছেই। এদের চিহ্নিত করতে হবে। মুখোশ-মানবদের শেষ নি:শ্বাসই শেষ সম্পদ। মৃত্যুর পর তাদেরকে নিয়ে স্মরণসভা কিংবা স্মৃতিসৌধ হয় না। ইতিহাসে তাদের স্থান হয় ‘পথভ্রষ্টতার নিদর্শন’ হিসেবে। মৃত্যুর পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত তারা কেবল খ্যাতি ও ক্ষমতার পিছনে ছুটেন। এসব ভ- অভিনেতা কেবলই নায়কের অভিনয় করে যায়, কিন্তু জীবনের প্রকৃত নায়কের স্বাদ অধরাই থেকে যায়। তাদের দম্ভ ও মূর্খতার থাবায় অধীনস্থরা লৌকিক হাসি প্রদর্শন করলেও প্রকৃত অর্থে তাদের জন্য ঘৃণা ও করুণা ছাড়া কিছুই থাকে না। আধুনিকতার নামে অমানবিক হওয়াটা তথা মানবিকতার বিকৃত সংজ্ঞা ধারণ ও প্রচার করাই এসব কর্তাব্যক্তিদের জীবনকর্ম। যার ফল কখনোই তৃপ্তি ও সরলতাকে স্পর্শ করতে পারে না।
আমরা একটা নির্দিষ্ট সময়ের সফরে পৃথিবীতে আগমন করেছি। ওই সময়সীমা অতিক্রম করে কোনো প্রাণীই টিকে থাকতে পারেনি। তবে যারা সততা ও শ্রমকে যথার্থ অনুধাবন করেছে তারা অক্ষয় হয়েছে, কালজয়ী হয়ে অময় হয়েছে মানবতার হৃদয়ে। তাই একটিবার আত্মমগ্নে ভাবুন, আপনার একটি অকর্মের ফলে অগণিত সৃজনশীল কর্ম থমকে যাচ্ছে। ভাবুন, আপনার একটি আত্মঘাতী সিদ্ধান্তের ফলে সদ্য পড়াশুনা শেষ করা চাকরিপ্রার্থী বেকারের জন্য তার ভবিষ্যৎ জীবনটা কতোটা জটিল হয়ে যাচ্ছে।
অনেক হয়েছে, এবার থামুন। আপনার মুখোশ খুলে ফেলুন। মানুষের সাথে, মানুষের পাশে আমৃত্যু মানবতার চর্চা করুন। অতীত ভুলের জন্য অনুতপ্ত আর ভবিষ্যতের জন্য মঙ্গলময় জীবনের দৃঢ় শপথ নিন। ভালোবাসায় সিক্ত থাকুন মানুষের অন্তরে। আমাদের শুভবুদ্ধি জীবিত হোক।
লেখক : কবি ও সাংবাদিক
পাঠকের মতামত: